এক অস্ফুট মায়া
রবিন। গ্রামের সকলেই ডাকে রবিনহুড বলে । বয়স এগারোর কাছাকাছি । রাস্তাতেই সে বড় হয়েছে । তার কোন আত্মীয় কিংবা পরিবারের কোন সদস্য ছিল না । তার মা ছিল পাগলী । নাম ছিল জয়নাব আক্তার রেখা । তাই গ্রামের লোকজন তাকে রেখা পাগলী বলে ডাকত । পাগলী হলে কি হবে সে কিন্তু তার ছেলে রবিনকে খুব ভালোবাসতো । এক মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করতে দিত না । এইতো কয়েকদিনের ঘটনা - গ্রামের কিছু মানুষ তার ছেলেকে কেড়ে নিবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল । তার ছেলের কাছে ভিড়তেই সে ইট ছুড়ে একজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেইদিন গ্রামের মাতব্বর নুরুল হক তাকে মেরে মেরে পুরো শরীর রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। ছোট্ট রবিন সেদিন অনেক কেঁদেছিল।হয়ত তার মায়ের শরীরের প্রত্যেকটি বেতের আঘাত সেও পেয়েছিল আর নয়ত বড় হয়ে এই অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল। রবিনের মা কিভাবে মারা গিয়েছিল সেটা কেউ জানে না। তাকে যে মেরে ফেলা হয়েছিল এ কথা কারও অজানা ছিল না। বিচারের ঠিক দুই সপ্তাহ পর হঠাৎ করেই রবিনের মা মারা যান। ছোট্ট শিশুটি তার মায়ের আচল ধরে বারবার হেচকা টান দিচ্ছিল আর কেদে কেদে বোধহয় এটাই বলছিল- আমাকে ক্ষুধা লেগে আছে আর তুমি এখনো ঘুম পারছ!
সেই দৃশ্য দেখে হয়তো সেদিন সবার ভেতরেই স্নেহ, ভালোবাসা জন্মেছিল। সেদিন মাতব্বর সাহেবও উপস্থিত ছিলেন।তিনিই হাত-পা টিপে রায় দিয়েছিল যে রবিনের মায়ের মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে, তাকে খুন করা হয়নি। যদিও তার মুখে এবং নাকে নখের আচড় দেখে নিরব জনগণ ঠিকই বুঝেছিল যে সে মারা যায়নি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তবুও জনগন কিছু বলতে পারেনি শুধু নীরবতাই পালন করেছিল। মাতব্বর এ ও বলেছিলেন যদি তার মাকে মেরে ফেলাই হবে তাহলে ছোট্ট শিশুটি জীবিত কিভাবে থাকে?
যাহোক সেদিন জনগণ যে পাগলির জন্য নিরবতা পালন করেছে, এটা আমাদের মানতেই হবে। তোমরা নিশ্চয়ই এতোক্ষণ ছেলেটার কথাই ভেবেছ! ছেলেটার কি হলো?কে তাকে নিয়ে গিয়েছিল? এইসব মাথায় আসারই কথা। ছেলেটির বয়স ছিল তখন মাত্র আড়াই বছর। সবাই তাকে নিতে চেয়েছিল কিন্তু আইনের লোক তাকে দেয়নি। আইনের লোক ছেলেটিকে লালনপালন করার জন্যে পরেরদিন একই গ্রামের জোহরা বিবিকে দিয়ে যায়। জোহরা বিবিকে গ্রামের সকলেই ডাকত আদরের বিবি বলে। অবশ্য এরও একটা সুন্দর কারণ ছিল। গ্রামের কানা-ন্যাড়রা, ফকির-ফাকরা, চোর-ডাকাত সকলকেই খুব খাতির করত। কেউ কোনদিন তার বাড়ি থেকে না খেয়ে আসতে পারেনি। নাহলে একখান পান গালপুরে খেয়ে যেত। আদরের বিবির তিনকূলে কেও ছিল না।এজন্য গ্রামের লোকজন মনে মনে আইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল, যে আইন এইবার অন্তত সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছে। এদিকে রবিনকে পেয়ে আদরের বিবির দিনকাল ভালই কাটছিল এবং সে যতটুকু পারছিল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল রবিনকে সুখে রাখার! খেলাধূলার সামগ্রী কিনে দেওয়া, নতুন পোশাক-আশাক কিনে দেওয়া।মোটকথা, আদরের বিবি তার প্রতি আদরের কোন কমতিই রাখেনি। যখন যেটা আবদার করত, আদরের বিবি একটু দেরিতে হলেও কিনে দিত। ঠিক যেন মায়ের মমতায় আগলে রাখে বিবি।এভাবেই দিন যায়, বছর পেরিয়ে যায়। আদরের বিবির ছোট্ট ঘরটিতে আদরের ছোট্ট রবিন বড় হতে থাকে। চৈত্রের একদেনে রবিন খেলাধূলা করে বাড়ি এসেই আদরের বিবিকে বলল, মা জলদি খাবার দাও খুব ক্ষুধা লেগেছে। আরে বাবা আমি তো সেই কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি, তুই হাত মুখ ধুয়ে নে আমি তোকে খাবার দিচ্ছি।আর শুন বাবা কাল থেকে দুপুরের খাবারটা নিয়ম-মাফিক খাবি; সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করবি। তুই এখন অনেক ছোট; কখন কি হয়! আমার তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় (আসলে রবিনকে হারানোর চিন্তাই সবসময় আদরের বিবিকে ঘিরে রাখে সারাক্ষণ)। বিবি ভাত হাতে রবিনকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য মাত্র সোপাতে বসেছেন; ঠিক সেই সময় গ্রামের কয়েকজন মানুষ সঙ্গে নিয়ে পুলিশ ঢুকে পড়ল আদরের বিবির বাসায়।পুলিশ দেখে বিবির বুঝতে দেরি হলো না যে কি চলতে চলেছে এখন! ভাতের থালা ফেলে আদরের বিবি তার আদরের টুকরাকে জড়িয়ে ধরে ফেলল।রবিন এমনিতেই পুলিশ দেখলে ভয় পেত; মাকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে সে খুবই ঘাবড়ে গেল। পুলিশ সুপার জানালো তারা রবিনকে নিতে এসেছে। কথাটি শুনে বিবির মাথাই যেন বাজ ভেঙে পড়ল। সে রবিনকে আরো শক্ত করে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো, নাহ! আমি রবিনকে ছাড়া বাঁচব না। রবিনকে আমি দিব না। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি; ওই আমার কলিজার টুকরা, আমার সাত রাজার ধন।এতোক্ষনে আশপাশের সকল মানুষ বিবির বাড়ির পাশে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে। দু-একজন মহিলা বিবিকে এও বলে সান্ত্বনা না দিচ্ছে যে--দিয়ে দে বইন, কি আর করবি বল; যার জিনিস তারা তো নিবেই। পুলিশের দুজন কর্মকর্তা ইত:মধ্যেই রবিনের হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে; কিন্তু কিছুতেই বিবি তাকে ছাড়তে চাইল না। তখন পুলিশ সুপার বলল, ছেড়ে দাও বিবি, আমরা তোমাকে তোমার ন্যায্য পারিশ্রমিক দিয়ে যাব।আদরের বিবি জোর গলা বলল, আমি আমার পারিশ্রমিক চাইনা, আমি আমার হীরার টুকরাকে চাই। ন্যায্য পারিশ্রমিকের কথা শুনে গ্রামের কয়েকজন মহিলা হিংসাতে জ্বলতে লাগল। আহ্ আগে জানলে ছেলেটাকে আমি পুষ্যি রাখতাম, অন্যজন বলল কে জানে রে বইন- না তো আমিও রাখতাম। মহিলাদের এমন উক্তি শুনে আরো দুজন পুলিশ পাঠালো এবং বলল জোর করে টেনে নিয়ে আস। বিবি তার আদরের রবিনকে খুব শক্ত করেই ধরেছিল কিন্তু চারজনকে সামাল দেয়ার মতো শক্তি ছিল না। বিবি জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল- ওকে ছেড়ে দাও, ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে; আমার হাত ছাড়া কারো হাতের খাবার খাবে না; আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না। দু-একজন পুরুষ যদিও বাধা দেবার চে চেষ্টা করেছিল; গনি ওসমান আর শেকান্দার হাত জোড় পর্যন্ত করেছিল পুলিশের কাছে-- আর বারবার বলেছিল ও সত্যি মা
রা যাবে স্যার; ঐ ছেলেকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু কোন লাভ হলো না। তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় বিবির মুখ দিয়ে শুধু একটি কথাই বের হচ্ছিল- আমি রবিনকে ছাড়া বাঁচব না; ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।
রাতটা নি:শব্দতাই কেটে গেল ঠিকই কিন্তু পরেরদিন সকলে আবার হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।পুরো গ্রামটিতে হৈ চৈ ছড়িয়ে দিয়ে বিবির শেষোক্ত উক্তিটিকে সত্য করে চির বিদায় নিল আদরের বিবি।
বি:দ্র: ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ।
আর কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।
Comments
Post a Comment