"গল্পটা একটু ভিন্নরকম"
মানুষ স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকে। একটি স্বপ্ন পূরণ হলে আরেকটি স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিই আমরা। তাইতো অনেক মনস্তাত্ত্বিক স্বপকে বেঁচে থাকার আত্মা বলে অভিহিত করেছেন। স্বপ্ন দেখতে কেনা চাই! তবে সব স্বপ্ন কিন্তু স্বপ্ন না। ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা! হাঁ এটাই খাঁটি সত্য। আমরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখি, সেটাও স্বপ্ন বটে কিন্তু সে স্বপ্নে আমাদের কোন হাত থাকে না। এটা নামে স্বপ্ন মাত্র। আসল স্বপ্ন হলো সেটা যেটা পূরনের ইচ্ছা মানুষকে কুড়ে কুড়ে খায়, ঘুমাতে দেয় না। তবে আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে স্বপ্ন দেখি। এক জনের স্বপ্নের সাথে অন্য জনের স্বপ্ন একটু হলেও ভিন্ন হবে। আমার মতে একজনের সাথে অন্যজনের স্বপ্ন পুরোটাই আলাদা হয়ে থাকে।
আজ এমনই এক গল্প বলব আপনাদের মাঝে।
চলে গেলাম এখন থেকে পনেরো বছর আগে। আমরা তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম। আমার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু ছিল। নাম ছিল বুলবুল আর বাবুল। একসাথে খেলতাম, একসাথে স্কুল যেতাম, একসাথে গোসল করতাম- আরো কত কি? হাঁ আমাদের সাথে যে আর সহপাঠী থাকতো না, তা কিন্তু নয়। আমরা অনেকেই দল বেঁধে স্কুল যেতাম, একসঙ্গে খেলতামও সবাই। কিন্তু আমরা তিনজনের জুটিটাই ছিল অন্যরকম। আমরা খেলাধূলা করলে তিনজনই একদিকে হতাম। আমাদের কোন খেলায় হারাতে পারেনি কেউ। আমরা যাই করিনা কেন আমরা তিনজন মিলেই করি এবং এটা আমাদের আগেই ঠিক করা ছিল।
আমরা স্কুলেও এক বেঞ্চে বসতাম। স্যারদের কাছে এরজন্য অনেকবার মাইরও(পিটুনি) খেয়েছি আমরা। স্যার রোল অনুযায়ী সিট নির্ধারণ করে দিত। সিট ভাগের নিয়মটা ছিল এইরকম:- "ধরুন একটা সিটে চারজন বসতে পারে। প্রতিটা বেঞ্চে জোড় রোল দুইটা আর বিজোড় রোল দুইটা করে বসবে।আর আমাদের তিনজনের রোলই ছিল জোড়; দুই, ষোল আর চার। সেই হিসেবে আমরা একসাথে তিনজন কোখনই বসতে পাই না। কিন্তু আমরা বসতাম। এ নিয়ে কোন বন্ধু আমাদের সাথে ঝগড়া করতে পারত না। আসলে ঝগড়া করার সাহসই পেত না কেউই। কারণ এ নিয়ে আমরা অনেকবার অনেকের সাথে ঝগড়া করেছি। এই ভয়ে আমাদের সিটেও কেউ বসতে চাইত না। অর্থাৎ একটা সিটে প্রতিদিন আমরা তিনজনই বসতাম।
এরজন্যই স্যাররা বোকা দিত। কিছুদন পর স্যাররাও জেনে গিয়েছিল আসল কাহিনীটা। তারপর থেকে সিট নিয়ে কেউ কিছু বলেনি"।
কিন্তু পড়া নিয়ে প্রতিদিনই পিটুনি খেত বুলু(বুলবুল কে সবাই বুলু বলে ডাকত)। আমরা যদিও তাকে পড়ার কথা বলতাম। কিন্তু সে পড়ত না। ক্লাস ফোরে তার চার রোল ছিল কিন্তু না পড়ার কারণে তার রোলটি আমি দখল করে ফেলেছি। এটা নিয়ে তার মা তাকে প্রচুর মেরেছিল। তবুও সে এতটুকুও বদলায়নি। একদিনের গল্প বলি:- "স্যার ক্লাসে ঢুকেই বই বন্ধ করতে বলল। একদিক থেকে সবাইকে পড়া ধরতে লাগল। 'হেয়ার অ্যান্ড টোরটইজ' গল্পটা থেকে প্রশ্ন ধরছিল। সেদিন অনেকেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি এবং স্যার তাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। স্যার সেদিন মারার দায়িত্বটা আমাকেই দিলো। আমরা সেদিন পিছন বেঞ্চে বসে ছিলাম। বাবুলের পাশেই যে বুলু দাড়িয়ে ছিল সেটা আমি খেয়ালই করিনি।হইছে কি আমি একদিন মেয়েদের হাতে পিটুনি খেয়েছিলাম। আর হাতে খেয়েছিলাম সেও আজ দাঁড়িয়ে ছিল। তাই প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল মনে মনে। স্যার বলল, আগে ছেলেদের মারো এবং সামনের বেঞ্চ থেকে মারা শুরু করো। আমি চট জ্বলদি পেছন থেকে উঠে এসেই তুলাধূনা শুরু করে দিলাম। অবশ্য মেয়েটাও টের পেয়েছিল যে আজ আর রক্ষা নেই। কিন্তু মেয়েটার কাছে পৌছা আমার সম্ভব হয়নি। পেছন বেঞ্চে এসে আমার হাত থেমে গিয়েছিল এবং আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। স্যার বলেই চলল, কি হলো? মারছো না কেন। কিন্তু আমি সেদিন কিচ্ছু বলতে পারিনি। কারণ আমি তো ওখানেই বসে ছিলাম, সে যে পড়া পারেনি এটাতো আমার জানার কথা ছিল। আর আমি সেটা খেয়ালই করিনি। এখন প্রানপ্রিয় বন্ধুটির গায় কিকিভাবে হাত তুলব?? এটা কি আমার দ্বারা সম্ভব। আমাকে দেখে বুলু সেদিন নিচ দিকে মুখ করে ছিল। আর আমি এতই কেঁদেছিলাম সেদিন, সেই কান্না আর সেই দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার। তো আমার কান্না দেখে ক্লাসের সবার চোখ কালো হয়ে গিয়েছিল সেদিন।আমাকে এইভাবে এইরকম করে কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখেনি। এবং আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। পরে যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি আমি খাটে শুয়ে আছি। এ কথা আমাদের গ্রামে ছড়িয়ে গিয়েছিল। আর হয়ত এর জন্য বুলুর মা সেদিন বুলুকে অনেক বোকেছিল। আমি টের পেয়েছিলাম হয়ত বুলুর মা বুলুকে এইসব কথা গুলাই বলেছিল :- লজ্জা করে না তোর, তোর সব বন্ধুরা পড়া পারে আর প্রতিদিন তুই দাড়িয়ে থাকিস । দ্যাখ,দেখে কিছু শিখ তার কাছ থেকে । তুই তার বন্ধু বলে তোকে মারতে পারল না, কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে গেল তোর জন্যে, তবুও হাত তুলল না । আমি হলে চড়িয়ে তোর গাল লাল করে দিতাম। তার পর থেকে প্রতিদিন রনি পড়া করে আসতে লাগল । আসতে আসতে সে ভালো ছাত্র হয়ে উঠতে লাগল । তাকে টেক্কা দেয়ার মতো কোন ছাত্রই ছিলনা। একদিন স্যার আমাকে অফিসে ডেকে পাঠালেন । প্রথমেই স্যাররা আমাকে ধন্যবাদ জানালেন । আর বললেন, " তোমার জন্যই ও বদলে গেছে, আমার বিশ্বাস সে ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছু হবে । আমি জাস্ট মাথা নাড়লাম দিয়ে চলে এলাম। এভাবে দিন এগোতে থাকে । বুলুর পরিবর্তনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমি আসতে আসতে পিছিয়ে পড়ি । সমাপনী পরীক্ষার রেজাল্টের দিন চলো এলো । আমাদের ক্লাসের টপ রেজাল্ট করল বুলু । তার ভালো রেজাল্টের খবর পেয়ে তার মামা তাকে অনেকদুরে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করল । সেই থেকে আমি তাকে দেখতে পাওয়ার সসম্ভাবনাও হারালাম। এভাবেই দিন যায়, বছর পেরিয়ে যায় ।
একদিন শুনলাম সে নাকি লন্ডন যাবে । ভেবেছিলাম এবার অন্তত দেখা করে যাবে। কিন্তু তাও হলো না। আমার সকল আশাকে সে নিরাশাই পর্যবেসিত করে লন্ডনে পাড়ি জমালো । আমি প্রতিদিন তাকে ভেবে কান্না করতাম। যদিও আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি, কিন্তু কাঁদলে আমাকে সেই আগের মতোই মনে হয়। মনে হয় আমি সেই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া সেই ছোট্ট শফিক, যে একদিন তার বন্ধুর জন্য কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হয়েছিল। কিন্তু সে বন্ধু আজ অনেক বড়লোক হয়ে গেছে; যে লন্ডনে পড়ালেখা করে সেকি বড়লোক না হয়ে পারে! আগে কাঁদলে মা এসে সান্ত্বনা দিত; আচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিত। কিকিন্তু মা ও আজ আমাকে দেখতে পারে না। এখন আমি কাঁদলে সে চোখ মুছিয়ে দেয়ার বদলে গালি জুড়ে দেই। আর দিবেই না কেন? তাঁ চিন্তাতে আমি ঠিকমত কিছু খেতামই না। পড়ালেখা চরছিল কোন রকমে। এভাবেই দিন কাটছিল আমার।
একদিন চৈত্রের শেষে একটা বড় আম গাছের নিচে বসে ছিলাম। হঠাৎ বাবুল ফোন দিলো। কিরে দোস্ত কি করিস? কেমন আছিস? বাবুলের সাথেও আর সেরকম কথা হয়না এখন। কিন্তু কথা হয়। মাসে দু-তিনবার। সেও আমাকে এই নিয়ে অনেকবার বুঝিয়েছে। আমার এক সপ্তাহ পরে জন্মদিন ছিল, আর সেটার জন্যই সে ফোন করেছে। প্রতিবার সে ই আমাকে আমার জন্মদিন মনে করিয়ে দেয়। জন্মদিনে রুমটা কেমন করে সাজাবে, কি ফুল দিয়ে সাজাবে, কি ধরনের কেক কিনবে, কোন কোন বন্ধুদের দাওয়াত দিবে; সব সে ই ঠিক করে। আমরা কেবলমাত্র মাস্টার্স শেষ করেছি। কেউই এখনো কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিনি।
আজ আমার জন্মদিন। প্রতিদিনের মতো আজও বুলু দারুণভাবে মিস করছিলাম।
কেক কাটতে যাব ঠিক সেই সময় এক ভদ্রলোক বিশাল এক ফুলের তোড়া নিয়ে, মুখ ঢেকে কেকের সামনের দিকে উপস্থিত। সে জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে লাগল, 'হ্যাপি বার্থডে টু ইউ'.......। তার গলার আওয়াজে সবাই যেন হা হয়ে দাঁড়িয়ে তার উইস সূচক বাক্য শুনতে লাগল। একটু পরেই সে মাক্স খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি তবুও তাকে চিনতে পারলাম না।সে চিৎকার করে বলে উঠল-- বন্ধু তোই আমাকে চিনতে পারছিস না, আমি তোর বন্ধু বুলু। কথাটি শুনেই সেই কান্না জুড়ে দিয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। আর কাঁদতে কাঁদতে বললাম, এতোদিন মনে করিসনি কেন, আমার সাথে দেখা না করে লন্ডন গেলি কিকিভাবে? এটা তোর ভালোবাসা।
বন্ধু আমার এতোক্ষনে রিপ্লে দিলো, আমি তোকে অনেক ভালোবাসি রে। সেদিনই বুঝে ছিলাম ভালোবাসা কি জিনিস। আর সেদিনই আমার ঢের শিক্ষা হয়েছে। তাই সেদিনই শপথ নিয়েছিলাম, আমি সেদিনই তোর সামনে এসে দাঁড়াব, যেদিন আমি বড় কিছু করতে পারব। আমি স্যারদের কথা শেষ পর্যন্ত সত্য করেছি। আমি এখন বিশ্বের নামকরা ডাক্তার গুলোর মধ্যে একজন ।
বি:দ্র: ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ।
আমাকে ফেসবুকে খুজে পেতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন ।।
Comments
Post a Comment