ভালোবাসার মানুষটাকে না'কি ভুলা সম্ভব না
ভালোবাসার মানুষ |
এক ছেলে এক মেয়েকে খুব ভালোবাসে। মেয়েটির নাম হুযাইফা এবং ছেলেটির নাম ইব্রাহিম খলিল। ইব্রাহিমের বয়স ছিলো চোদ্দ বছর এবং হুযাইফার এগারো বছর। ইব্রাহিম প্রতিদিন হুযাইফাকে দেখার জন্য সে তার কাছে ছুটে যেতো। এক পর্যায়ে তাদের ফ্রেন্ডশিপও হয়। কিন্তু কখনো সে বলতে পারেনি যে সে তাকে ভালোবাসে। এইভাবেই চলতে থাকে। তারা একটু একটু করে বড় হতে থাকে। যখন ইব্রাহিমের বয়স আঠারই পা দিলো তখন হূজাইফার বয়স ছিল পনেরো। এখন তারা আর ছোট নাই। এখন চাইলেই তারা দুজন দুজন কে অনেককিছুই বলতে পারে। একদিন হুযাইফা তাদের বাগানে একটি গাছের নিচে দাড়িয়ে ছিলো। আশেপাশে কেউ ছিলো না। ইব্রাহিম মনে মনে ভাবলো এটাই সুযোগ। আর কত ধর্য ধরবে একটি কথা বলার জন্য, এখন তো তারা ছোট নাই। তাই সে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলো এবং জড়িয়ে ধরলো আর বলে ফেললো যে - সে তাকে পছন্দ করে, তাকে ভালোবাসতে চাই। হুযাইফা তাকে ছেড়ে দিতে বলল, কেউ দেখে ফেলবে এর ভয়ে। কিন্তু ইব্রাহিম তার প্রশ্নের জবাব না দেওয়া পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হলো না। হুযাইফা জোরে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগলো। তাই বাধ্য হয়ে ইব্রাহিম তাকে ছেড়ে দিলো। এবার মেয়েটি কোনো উত্তর না দিয়েই পাশ কাটিয়ে জোরে জোরে হেঁটে বাড়ি চলে গেলো। এদিকে ছেলেটি চিন্তায় পড়ে গেল। সে যতদূর জানে - তারা দুজন দুজনের খুব ভালো বন্ধু। একে অন্যকে তারা পছন্দও করে। তাহলে সে এমন করলো কেনো! সে যদি তাকে পছন্দ নাই ই করবে, তাহলে এতদিন একসঙ্গে থাকার মানেই বা কি। সে কখনোই নিজেকে সান্তনা দিতে পারলো না...। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো হুযাইফাকে এভাবে আচমকা ধরা ঠিক হয়নি। ভাবতে ভাবতে রাত ঘনিয়ে আসলে সারারাত সে ভাবতেই থাকে। আমি এটা কি করলাম! এতো দিনের বন্ধুত্ব। কেউ কাউকে আজ পর্যন্ত এতটুকু কষ্ট দেইনি। আর আজ আমি গুজাইফাকে কষ্ট দিলাম। ভাবতে ভাবতে সে নিজেকে আঘাত করতে থাকে।
হুজাইফা সেদিন থেকে ইব্রাহিমের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দেই। দেখা করা বন্ধ করে দিলে ইব্রাহিম আরও বেশি টেনশনে পড়ে যায়। সে হুযাইফাকে দেখার জন্য কখনো রাস্তায়, কখনো তার স্কুল মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু হুযাইফা দেখা আর পাইনা। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেলো হুযাইফাকে সে দেখেনি কথাটি ভাবতেই ইব্রাহিমের গা শিহরিত হয়ে উঠে, চোখ দিয়ে অঝোরে নেমে আসে অশ্রু। ইব্রাহিম আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। এবার সে সরাসরি তার বাড়িতে গিয়ে তাকে জবাব দেয়ার জন্য হাঁটতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো তাকে ইচ্ছে মতো বকা দেবো। কি এমন ক্ষতি করেছে সে তার, কতটুকু ক্ষতি হয়েছে। তোমার সব ক্ষতিপূরণ- পূরণ করে দেব।
মাথায় এটা সেটা ঘুরপাক খায় আর রাগে রাগে এগিয়ে যায়। সে যখন তাদের গেটের কাছাকাছি পৌঁছালো ঠিক তখনই এখন তাকে জিজ্ঞেস করলো: সে কোথায় যাবে? লোকটি তাকে আগে থেকেই চিনতো এবং এও জানতো যে হুযাইফা তার ভালো বন্ধু। ইব্রাহিম যেহেতু রাগের মাথায় ছিলো, তাই সে হুট করে রেগেই বললো যে সে হুযাইফার কাছে যাবে। তাই সে উত্তর দিয়েই হাঁটতে শুরু করলো। সে যখন কিছুদূর চলে গেছে ঠিক তখনই লোকটি বললো যে, হুযাইফা তো বাড়িতে নেই। তাদের পরিবার জার্মানি চলে গেছে, তাদের যা কিছু ছিলো সব বিক্রি করে দিয়েছে। জমিদার রাজ্জাক তার সমস্ত সম্পত্তি কিনে নিয়েছে। তাদের গেটে এখন তালা মারা আছে। তুমি সেখানে গিয়ে কি করবে?
ইব্রাহিম এতক্ষণ তার দিকে ফিরেই তাকায়নি, সে শুধু অন্যদিকে মুখ করে শুনছিল কথাগুলো। কথাগুলো শুনার পরে ইব্রাহিম আর কোনো উত্তর দেইনি। সে এবার মেয়েটির বাড়ির দিকে রওয়ানা না দিয়ে বিপরীত দিকে মাথা নিচু করে, বৃদ্ধ মানুষের মতো হাঁটা শুরু করল। তার চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরতে ছিলো, মুখে কোন আওয়াজ ছিলো না। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর সে একটি পুকুরের ধারে বসে পড়লো। তার কান্না কিন্তু থামেনি। যোহর গেলো, আসর গেলো, একটু পর যখন মাগরিব ঘনিয়ে এলো। তখন আমরা তাকে উঠে দাড়াতে দেখলাম। এবার তাকে দুর্বল অবস্থায় দেখা যায়নি, মনে হলো সে নিজেকে শক্ত করেছে। তাকে পুকুরে নেমে মুখ হাত ধৌত করতে দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম মুখ হাত ধুয়ে বাড়ি চলে যাবে। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল হলো। আমাদের সবার ধারণাই ভুল হলো। এতদিন যাবৎ যাকে কেউ মসজিদে দেখেছে কি'না সন্দেহ, সে আজ পুকুরের পারে নামাজ পড়তে দাড় হলো। আমরা চমকে গেলাম।
তখন থেকে সেই যে নামাজ ধরলো আর নামাজ ছাড়েনি সে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সে। কখনো কখনো কোরআন নিয়েও বসে থাকে, কিন্তু জোরে জোরে পড়ে না। বেশ কিছুদিন ধরে হাফেজ মকবুলের কাছে কোরআন শিখেছে, হয়তো পুরোপুরি শিখা হয়নি এজন্যই আসতে আসতে কোরআন পড়ে। তার লেখাপড়ার দিকেও আমরা দৃষ্টি দিয়েছি। সে আগের চেয়ে অনেকগুণ বেশি পড়া লেখা করছে এখন। আগে যেখানে তার ক্লাস রুল থাকতো ২৫-৩০ এর দিকে। এখন তার রুল থাকে ৩'৪ কিংবা ৫। এই আমূল পরিবর্তন দেখে তার পরিবারও তার প্রতি যত্ন শুরু করে দিয়েছে। তার বাবা বাজারের টাটকা সবজি ছাড়া বাজারই করে না। এখন ইব্রাহিম অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাকে প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে। কারণ তার এখন একটাই স্বপ্ন তাকে মানুষ হতে হবে। এসবের মাঝে সে একটি বারও হুযাইফার কথা মনে করেনি। কারণ সে তার লক্ষ্য পথভ্রষ্ট করতে চাইনা।
দিন এভাবেই যেতে থাকে। চারদিকে ইব্রাহিমের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সবাই জানে ছেলেটি ছাঁকা খেয়ে বদলে গেছে। কিন্তু ছাঁকা খেয়ে নিজেকে পাল্টে ফেলার ঘটনা আমাদের সমাজে বিরল।
Comments
Post a Comment